Thursday 6 February 2020

বাংলাদেশে ওয়াজগুলোর সাব-টেক্সট পাঠ।



আমার ছেলে বেলার কয়েকটা স্মৃতির একটি হচ্ছে সিলেটে আলিয়া মাদ্রাসায় সাঈদীর ওয়াজ, রোজায় অলিপুরির ওয়াজ, শুক্রুবার বা কোন অপরচুনিটিতে প্রয়াত প্রিন্সিপাল হাবিবুর রহমান সাহেবের ওয়াজ। কিছু মানুষ তখনো সাঈদীর ওয়াজকে অপসন্দ করতেন কারন ছিলো তাদের পলিটিক্যাল এনগেজমেন্ট। অলিপুরি ওয়াজে অর্থনীতির ব্যাখ্যা দিতেন “ অর্থ মানে টাকা , নীতি মানে নিয়ম। টাকা-পয়সার নিয়ম নীতি” হাবিবুর রহমান সাহেব (খা)লেদা অর্থ্যাৎ গোবর আর (হা) চেনা অর্থাৎ পস্রাব অথবা তসলিমা ব্যাশিং এবং রুশ-ভারত-মার্কিন ফুরিয়ে গেছে তোদের দিন টাইপের শ্লোগান নির্ভর ওয়াজ ।

আমাদের অঞ্চলের এই ওয়াজগুলোর দুটো দিক ছিলো, বৃহদার্থে অর্থনীতিক এবং ক্ষুদ্রার্থে রাজনীতিক। অলিপুরি বা হাবিবুর রহমান সাহেবদের ওয়াজের প্রভাব- প্রচার বা প্রাসার কোন প্রাতিষ্ঠানিক বা পরিকল্পিত ছিলোনা। খালে যেভাবে পার্শ্ববর্তি নদীর জোয়ারে বান আসে আবার বিকালে হারিয়ে যায় তেমনি ছিলো। কিন্তু সাঈদীর ওয়াজ ছিলো একটি বৃহৎ প্ল্যানের অংশ, সেই সব ওয়াজের পেছনে সাব টেক্সটের মতো আরও কিছু কথা ছিলো। সেই ওয়াজ গুলো নির্দিষ্ট কিছু মানুষকে এনার্জাইজ করতো।

ওয়াজের সময়গুলো ছিলো শীতকাল। স্কুল কলেজ ছুটি থাকতো, সন্ধ্যায় আয়োজন হতো। সুন্দর সুন্দর ডিজাইনের পোষ্টার, তোরণ, চারিদিকে উৎসব উৎসব ভাব। সেই ওয়াজে ক্ষমতায় থাকা বিএনপি বা আওয়ামীলীগের নেতা-কর্মি সকলেরই অংশগ্রহণ থাকত। তবে সাঈদীর ওয়াজে কওমি মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষকদের উপস্থিতি খুব কম থাকতো।

সাঈদীর ওয়াজগুলো হয়ে যেতো ইসলামিক মহা সম্মেলন তা তাফসিরুল কোরআন মাহফিল। এখানে মাজার বিষয়ক ধর্ম ভাব সমালোচিত হতো। সাঈদীর মাহফিলে দেশ বিদেশের কথা শুনা যেতো, যেমনটা আপনারা হিন্দি সিনেমায় বিদেশ ঘুরে আসেন। মাঝে মাঝে ইংলিশ বাক্য শুনা যেতো। সেই সময়ে এক টুকরা ইংলিশ আমাদের চোখ কে বিস্মিত করতো। বাংলায় ইসলামিক গাণ থাকত। মহিলাদের জন্য আলাদা ওয়াজের ব্যাবস্থা থাকতো। মহিলাদের সেইসব আয়োজন কোন কোন ফ্যামিনিষ্টদের পক্ষেও করা সম্ভব ছিলোনা। যে সব স্বামীরা বউকে বাইরে যেতে দিতে চাইতেন না তারাও এই ওয়াজে স্তীর যাবার ইচ্ছাকে নিরোধ করেত পারতেন না।

অনেক মানুষের মনের গহীনে এই ওয়াজ নিয়ে বছর ঘুরে অপেক্ষা থাকতো। কি ছিলো এই সব ওয়াজে? পান্ডিত্যের দিক থেকে সাঈদীর চেয়ে আরও জ্ঞানী-গুণি ছিলেন সিলেটের ওয়াজের বাজারে কিন্তু তারা সাঈদীর হাতে সব সময় আউট নাম্বার হতেন।

কথা বলা একটি আর্ট এবং এই আর্টের আরও একটি ভয়ঙ্কর দিক হলো কথা কে বিশ্বাসে রুপান্তরিত যারা করতে পারে তা তখন ভয়ঙ্কর এক আর্ট-লর্ডে রুপান্তরিত হন। সেখানে যুক্তি বা প্রমান সবসময় অপুষ্টিতে ভোগে। এই ওয়াজগুলোর প্রধান কেন্দ্র ছিলো চট্রগ্রাম এবং সিলেট। দুটো যায়গাতেই পয়সা ছিলো, সংখ্যা ছিলো আর ছিলো বিশ্বাস।

সেই বিশ্বাসের ঘরে প্রথম হালকা ঢেউ নিয়ে আসে ১৯৯৬। আওয়ামিলীগের শাষণ। ইসলাম-এন্টাই ইসলাম এবং রাজনীতি মুখোমুখি। সেই লড়াইয়ে ইসলামের লুন্ঠিত প্রায় ঝান্ডার দখল সাঈদীমনাদের হাতে তা প্রতিষ্ঠা করতে সহযোগিতা করলো আওয়ামীলীগ। স্বাধীনতার পর প্রথমবারের মতো জোরেশোরে ইসলাম বিপন্ন হতে পারে তা প্রচার এবং প্রতিষ্ঠা পেতে থাকল সেই সময় থেকে।

জামায়াতমনা রাজনীতি বাংলাদেশের ক্ষমতার মসনদে যেতে সর্ব আয়োজনে এগিয়ে যাচ্ছিলো। তাদের এই প্যারাসাইটিক যাত্রায় বিএনপি ছিল তাদের ক্যারিয়ার। তারা সকল অঙ্গনে এগিয়ে যাচ্ছিলো, তাদের প্ল্যাণও কাজ করছিলো। সরকারি ক্যাডার সার্ভিসে, চিকিৎসায়, শিক্ষাঙ্গনে , ব্যাবসায়, আদর্শ কিশোর-যুবক নির্মানে, সাহিত্য-সংষ্কৃতিতে, সামরিক-বেসামরিক বাহিনীতে সব যায়গায় তারা অবস্থান নিশ্চিত করছিলেন। এই যাত্রায় সেই ওয়াজ-মাহফিলগুলো ছিলো শক্তি-আস্থা প্রদর্শন বা প্রকাশের সবচেয়ে সাস্টেইনেবল পথ। এই ম্যাকানিজম নতুন কিছু নয়। এটি পরীক্ষিত টেকনিক। ভারতের আরএসএস বা শিবসেনা বা বজ্রং দল বিজেপি-কে ক্যারিয়ার করে একই টেকনিকে এগিয়ে যাচ্ছিলো। মধ্যপ্রাচ্যে মুসলিম ব্রাদারহুড আর বাংলাদেশে জামায়াত সেই একই টেকনিকে এগিয়ে যাচ্ছিলো। এই দলগুলো একেকটি ক্যাডার ভিত্তিক বড় গেইমের খেলোয়াড়। এগুলো বড় ঝড়েও হারিয়ে যায়না। এদের দূর্বল করা যায় কিন্তু নির্মুল করা যায় না। অনেকটা ক্যান্সারের মতো, বারে বারে ফিরে ফিরে আসে।



একটি ওয়াজ মাহফিল বা পূজা বা যে কোন অনুষ্ঠানে একজন মানুষ আসে সেই অনুষ্ঠানকে তার নিজের ভেতর ধারনে করে বা ধারন করবে অন্তত মনযোগ দিয়ে শুনবে এমন একটি মানসিক অবস্থান নিয়েই আসেন। তাই ওয়াজ-মাহফিলগুলো নির্দিষ্ট আইডীওলজির জন্য অত্যন্ত ভাইটাল। 





বাংলাদেশের ওয়াজের বাজারে মানবতা বিরোধী বিচারে সাজাপ্রাপ্ত সাঈদীর অনুপস্থিতির মধ্য দিয়ে যে শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছিলো তা ছিলো সাময়িক এবং তা পূরণে এগিয়ে এসেছে একদল তরুণ ওয়াজি। এরা এদের পূর্বশূরিদের চেয়ে আরও দক্ষ, সচেতন এবং এই আর্ট ফর্মের ডিজিটাল ওয়ার্ল্ডের সুবিধাভোগি। হাল আমলে যে আযহারি, জাফরি, ইব্রাহিম সাহেবদের দেখা যায় তারা কারা? এরা শুধুই একেকটি নাম ।লক্ষ্য তাদের অভিন্ন্‌, ইসলামিক ব্রাদারহুডের মন্ত্রে এরা দিক্ষিত। এরা রাষ্ট্র কেন্দ্রিক ইসলামের প্রতিষ্ঠা চান। এই আইডিওলজিক্যাল প্যারাসাইটকে তারা ছড়িয়ে দিতে ক্যারিয়ার হিসেবে যে সব বাংলাদেশিদের পান তাদের সংখ্যা কোন ভাবেই হেলায় ফেলে দেয়ার মতো নয়। এদেশের হাড়ে প্রোথিত বামও এক্ সময় এর ক্যারিয়ার হয়ে উঠেন, নীরবে বা অপ্রকাশ্যে। বেচে থাকার লড়াই বা আয়েশ অথবা লোভের মইয়ে চড়তে ব্যাকুল সাধারণ মানুষ তাদের নির্বাণের লক্ষ্যে জীবনের এক সময় ধর্ম বা বিশ্বাসের ছাতায় আশ্রয় নিতে ফিরে আসে। এমন ক্যারিয়ার পেলে যেকোন প্যারাসাইট বেচে থাকতে পারে যুগের পর যুগ। বাস্তবতা হলো এমন তথাকথিত অসাম্প্রদায়িক বা সেন্ট্রিষ্ট রাজনিতিক প্রতিষ্ঠানগুলো পর্যন্ত এগুলোর মোকাবেলা করতে অক্ষম। তারা দুধারী তলোয়ারের মুখোমুখি। কিন্তু রাজনিতিক প্রতিষ্ঠান বা রাজনীতিবিদেরা তাদের ওয়ে আউট বের করে ফেলেন। যেমনটা বাংলাদেশে ঘটেছে। জামায়াতের মতো আইডিওলজির সাথে লড়তে হেফাজত কে ঘারে নিয়ে বসেছে সরকার। লুটেরা জালিম সরকার তাদের নিজেদের গোল অর্জনে যখন জামায়াত পন্থিদের উপর অত্যাচার-নির্যাতন চরমে তুলেছে তখন নীরব বা উদাসীন বা ইমোশনাল ক্যারিয়ারগণ ধীরে ধীরে অন্যান্য কারনের সাথে সাথে এই প্যারাসাইটদের প্রতি দূর্বল হয়ে ঊঠছে। অপর দিকে এন্টাই জামায়াত গোষ্ঠীও জানে সরকার বা ইষ্টাব্লিশমেন্ট এক সময় তাদের ছুড়ে ফেলবে এবং তাদের নিজেদেরও অমোঘ লক্ষ্য অর্জনে এক সময় এক হতেই হবে তাই এক বিশাল আন্ডারস্ট্যান্ডিঙয়ের দিকে যাচ্ছে বাংলাদেশের ইসলামিক সমাজ। সরকার উন্নয়নের নামে, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির নামে, বিচারের নামে যা কিছুই করছে তার বহিঃ রুপ হচ্ছে ইসলামের উপর আক্রমন। দুটি পক্ষই একে অপরকে সর্বাংশে বিশ্বাস করেনা। কোথাও কারো ওয়াজ বন্ধ করে দেয়া কে আজ যদিও একক ঘটনা হিসেবে দেখছেন তা একদিন মুসলিম সমাজের উপর হামলা হিসেবে চিত্রিত হবে। নাটক-সিনেমায়, পাঠ্যক্রমে , চাকরি-ব্যাবসায়, আইন-আদালতে মূল ধারার ইসলাম যে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে তা নিঃসন্দেহে একদিন বুমেরাং হয়ে ফিরে আসবে সরকারকে বা সরকারপক্ষের দিকে।

ফিরে দেখুন ভারতের দিকে, আমেরিকার দিকে অথবা ব্রিটেনের দিকে। কার্যত কোন বিরোধী মত সেখানে শক্তিশালী নয়। জনগণও তাদের চাইছেনা। আল্ট্রা জাতীয়তাবাদ এবং সংকীর্ণ স্বার্থ সামনে আসছে এবং রুল করছে। মেজরিটি আর কমপ্রোমাইজ করতে প্রস্তুত নয়। পপুলিজমের জয়জয়াকার সবখানে। মসজিদের মিম্বর নির্ভর ইসলাম এখন ডিজিটাল ফর্মে। মানুষ এখন নিজ সীমানা ছাড়িয়ে ইসলাম জানতে পারছে। কম্যুনিজম ডুবেছে, ডেমোক্রেসি বিকেছে, মুসলিম সমাজ তাদের মুক্তির জন্য কোন পথ খুজে পাচ্ছেনা। আইডেন্টিটি ক্রাইসিসের এই মুহুর্তে বাংলাদেশ বা বাংলাদেশী পরিচয় যথেষ্ট থাকবে না। বাংলাদেশী মুসলিম আইডেন্টিটি সামনে এগিয়ে আসবে। এই যাত্রায় ভারত, আমেরিকার কন্ট্রিবিউশন থাকবে ব্যাপক ভাবে।

এই অবস্থা মোকাবেলা করবেন কিভাবে?

ক্রেডিবল পথ হচ্ছে একটি শক্তিশালী বিরোধীদল সৃষ্টি করা। ভারত বা আমেরিকার মতো শক্তিশালী সংবিধান প্রণয়ন এবং ক্ষমতার চেক এন্ড ব্যালেন্স ক্রিয়েট করা।

এই সমাধানের সবচেয়ে বড় কয়েকটি অন্তরায় শেখ হাসিনা, খালেদা এবং তাদের বংশধরদের রাজনীতিতে অবস্থান। ব্যাবসায়িদের রাজনীতিতে অংশ গ্রহণ, ত্রুটিযুক্ত রাষ্ট্রিয় কাঠামো।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে যে মানবতা বিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়েছে তা সত্যিকার অর্থে স্বাধীন আলাদা আদালত ম্যাকানিজম ক্রিয়েট করে বিচার অব্যাহত রাখা। জার্মানির মতো সামনে যাবার প্রত্যয়ে সবাইকে সাথে নিয়ে কাজ করা। প্রাদেশিক শাষণ ব্যাবস্থা চালু করা। রাষ্ট্রপতি- প্রধানমন্ত্রী নির্বাচন বাতিল করে প্রদেশ প্রধানদের থেকে রাষ্ট্রপতি- প্রধানমন্ত্রী নির্বাচন করা। রাষ্ট্রের সকল স্তরে প্রপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন মূলক ব্যাবস্থা নিশ্চিত করা। সকলের চাহিদার যোগান রেখে এক ও অভিন্ন শিক্ষা ব্যাবস্থা প্রণয়ন করা।