Wednesday 5 June 2019

চাঁদ দেখা এবং মুসলমানদের পিছিয়ে থাকার পণ।


বাংলাদেশে ঈদ নিয়ে যা হলো তা নিয়ে কি আপনি ক্ষুব্ধ? হতাশ?
ক্ষুব্ধ আপনি হতেই পারেন, হতাশও। তবে ভুলে যাবেন না আপনার কাজ আপনি অন্যের কাছে দিলে এমন হতে পারে এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ইহা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ, ইসলামিক রিপাবলিক বা খেলাফত নয়। এই সমস্যা আপনারই হাতে সৃষ্ট এবং এর সমাধান আপনার হাতেই নিহত।
ঈদ ও ঈদের চাঁদ নিয়ে যে সমস্যা তা কি এবং কিভাবে এর স্থায়ি সমাধান করা যায়?
ইসলামিক জীবন যাপনে হিজরি সাল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রোজা, হজ্ব, যাকাত ইত্যাদিতে নির্দিষ্ট মাস সম্পৃক্ত তাই সেই মাস কখন শুরু কখন শেষ তা জানা এবং অনুসরণ করা জরুরি। হিজরি সাল গণনা চাঁদ কেন্দ্রিক। অর্থ্যাৎ চাঁদ দেখে শুরু, চাঁদ দেখে শেষ। অন্যান্য মাসের শুরু শেষ নিয়ে তর্ক-বিতর্ক-কুতর্ক না হলেও রোজার মাস নিয়ে তর্ক-বিতর্ক-কুতর্ক বিদ্যমান।
রোজা নিয়ে কোরানে সর্বসাকুল্যে আছে ৪টি আয়াত এবং এই আয়াত গুলোতে রোজার গুরুত্ব বিধি নিষেধ আলোচনা হয়েছে।

তোমরা যারা বিশ্বাস করেছ, শোনো, তোমাদের উপর রোজা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে, যে রকম তোমাদের পূর্বপুরুষদের উপর করা হয়েছিল। যাতে করে তোমরা আল্লাহর প্রতি সচেতন হও। [আল-বাক্বারাহ ১৮৩]

রোজা নির্দিষ্ট কিছু দিন। তাই তোমাদের মধ্যে কেউ যদি অসুস্থ থাকে, বা সফরে থাকে, তাহলে পরে একই সংখ্যক দিন পূরণ করবে। আর যাদের জন্য রোজা রাখা ভীষণ কষ্টের, তাদের জন্য উপায় রয়েছে — তারা একই সংখ্যক দিন একজন গরিব মানুষকে খাওয়াবে। আর যে স্বতঃস্ফূর্তভাবে বাড়তি ভালো কাজ করে, সেটা তার জন্যই কল্যাণ হবে। রোজা রাখাটাই তোমাদের জন্যই ভালো, যদি তোমরা জানতে। [আল-বাক্বারাহ ১৮৪]

রমজান মাস, যখন নাজিল হয়েছিল কুর’আন —মানুষের জন্য পথনির্দেশ, পরিস্কার বাণী যা পথ দেখায় এবং সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারী। তাই তোমাদের মধ্যে যে সেই মাসটি পাবে, সে যেন রোজা রাখে। আর কেউ যদি অসুস্থ থাকে, বা সফরে থাকে, তাহলে সে যেন পরে একই সংখ্যক দিন রোজা রেখে পূরণ করে নেয়। আল্লাহ তোমাদের জন্য সহজটাই চান, তিনি তোমাদের জন্য কঠিনটা চান না। তিনি চান তোমরা যেন নির্ধারিত সময় পূরণ করো, তোমাদেরকে পথ দেখানোর জন্য তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করো, আর যেন তোমরা কৃতজ্ঞ হতে পারো। [আল-বাক্বারাহ ১৮৫]

রোজার রাতে স্ত্রীদের সাথে ঘনিস্ট হওয়া তোমাদের জন্য বৈধ করা হয়েছে। তারা তোমাদের পোশাক, তোমরা তাদের পোশাক। আল্লাহ জানেন যে, তোমরা নিজেদের সাথে প্রতারণা করছিলে। তাই তিনি তোমাদেরকে ক্ষমা করেছেন, তিনি তোমাদেরকে নিঃশর্তে মাফ করে দিয়েছেন। এখন তোমরা তাদের সাথে মিলিত হও, আর আল্লাহ তোমাদের জন্য যা নির্ধারণ করে রেখেছেন, তা পাওয়ার চেষ্টা করো। খাও, পান করো, যতক্ষণ না ভোরের সাদা রেখা অন্ধকারের রেখা থেকে স্পষ্টভাবে আলাদা না হয়। তারপর রাত আসা পর্যন্ত রোজা সম্পূর্ণ করো। মসজিদে ইতিকাফ করা অবস্থায় স্ত্রীদের সাথে মিলিত হবে না। এই হলো আল্লাহর দেওয়া সীমা, এর কাছেও যাবে না। এভাবে আল্লাহ তার বাণীকে মানুষের জন্য পরিস্কার করে দেন, যেন মানুষ অন্যায় থেকে নিজেকে বাঁচাতে পারে। [আল-বাক্বারাহ ১৮৭]

উপরোক্ত আয়াত গুলোতে রোজার মাস শুরু বা শেষ বা ঈদ পালন নিয়ে কোন নির্দেশনা নেই। তবে রোজার মাসের সমাপ্তি নিয়ে একটি হাদিস রয়েছে।

 বুখারি ১৯০৯ নাম্বার হাদিসে এসেছে, আবূ হুরাইরা কর্তৃক বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “তোমরা চাঁদ দেখে   রোজা রাখ   এবং চাঁদ দেখে রোজা ছাড়। যদি (কালক্রমে) তোমাদের উপর আকাশ মেঘাচ্ছন্ন হয় (এবং চাঁদ দেখতে না পাওয়া  যায়), তাহলে শা’বান (মাসের) গুণতি ত্রিশ পূর্ণ করে নাও।”
এবং মুসলিমের ১০৮১হাদিসের বর্ণনায় আছে, “তোমাদের আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকলে ত্রিশ দিন রোজা রাখ।
যেহেতু কোরআন সরাসরি রোজার সমাপ্তি নিয়ে সমাধান দিচ্ছেনা তখন হাদিসের দিকে সমাধান খুজতে মুসলমানগণ বাধ্য। লক্ষ্য করুন হাদিসটি একটি সমস্যার সমাধান দিচ্ছে, যদি চাঁদ না দেখা যায় তবে কি করতে হবে? ১৪শ বছর আগে যে সমাধান দেয়া হয়েছে তা লজিক্যাল কিন্তু সব সময়ের জন্য নয়। এমন এক সময়ে যখন ঘোড়া ছিলো সবচেয়ে দ্রুততম যোগাযোগ মাধ্যম। যখন মানুষ নিজ চোখের কার্যক্রমের  পরিধি বাড়াতে সক্ষম ছিলোনা। তাই লজিক্যালি আরবি মাস গণনায় সর্বোচ্চ ৩০ দিন পর্যন্ত রোজা রাখার বিধান সেই সময়ে যথার্থ।
মানুষকে অনুধাবন করতে হবে নামাজ বা যাকাত পালনে সময়ের বা দিন-মাসের যে ফ্যাক্টর যেভাবে বিবেচিত হয় তা রোজার মাসের শুরু বা শেষ নির্ধারনে বিবেচ্য হবেনা। আমাদের এই পৃথিবীতে চাদ একটাই। আমেরিকা বা ইউরোপ বা আফ্রিকাতে যে চাঁদ দেখা যায় তা এশিয়াতেও দেখা যায়। যদি কেউ কোন কারনে না দেখতে পান তার মানে নয় চাঁদ সেদিন ছিলোনা, চাঁদ ও পৃথিবীর অবস্থান এবং তার প্রেক্ষিতে দৃশ্যমান হওয়ার উপর ভিত্তি করেই আরবি মাস গণনা শুরু বা শেষ হয়।  তাই রোজার মাসে যখন চাঁদ দেখা না যায় তার মানে এই নয় যে আপনি ত্রিশতম দিন রোজা পালন করবেন, চাঁদ কোথায় দেখা গিয়েছে তা খোজ করবেন। যদি পৃথিবীর কোথাও চাঁদ না দেখা যায় তখন আপনার উপর নির্দেশনা রয়েছে ত্রিশতম দিনে যাবার। যদি আপনি মনে করেন কোন অমুসলিমের সাক্ষ্য এই বিষয়ে গ্রহণযোগ্য নয় তবে কোন মুসলিমকে চাঁদ দেখার জন্য পাঠানো কিংবা নিজেদের সক্ষমতা (ম্যাকানিক্যাল) বাড়ানো উচিত।    
কোরানের সুরা আল আম্বিয়া, চ্যাপ্টার ২১, ভার্স ৩৩ এ বলা হয়েছে,
তিনিই সৃষ্টি করেছেন রাত্রি  দিন এবং সূর্য  চন্দ্র। সবাই আপন আপন কক্ষপথে বিচরণ করে।
মানুষ চাঁদের চলার পথের বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করেছে। এবং তা প্রয়োগ করছে। তাই কোন সরকার বা কোন গোষ্ঠির বা ব্যাক্তির স্বীকৃতির উপর জিম্মি থাকতে পারেনা, এদের দেখা না দেখাতে চাদের অবস্থান বদল হয়না।
২০১৬ সালের মে মাসে ইস্তাম্বুলে এক আন্তর্জাতিক সম্মেলন হয়েছিল তুরস্কের উদ্যোগে। সেখানে তুরস্ক, কাতার, জর্ডান, সৌদি আরব, মালয়েশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মরোক্কো সহ ৫০টি দেশের ধর্মীয় পন্ডিত এবং বিজ্ঞানীরা অংশ নেন। ইন্টারন্যাশনাল হিজরি ক্যালেন্ডার ইউনিয়ন কংগ্রেস নামে পরিচিত এই সম্মেলনে হিজরি ক্যালেন্ডার নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন
দেশের মুসলিমদের মধ্যে যে বিভক্তি সেটা নিরসনে এক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
সম্মেলনে দুটি প্রস্তাব বিবেচনা করা হয়েছিল। প্রথমত সারা বিশ্বের জন্য দ্বৈত বর্ষপঞ্জী চালু করা, পূর্ব গোলার্ধের জন্য একটি, আর পশ্চিম গোলার্ধের জন্য একটি। আর দ্বিতীয় প্রস্তাবটি ছিল, সবাইকে একটি বর্ষপঞ্জীর মধ্যে নিয়ে আসা।
শেষ পর্যন্ত বেশিরভাগ প্রতিনিধি এবং বিশেষজ্ঞ একটি বর্ষপঞ্জীর পক্ষেই মত দেন।
বাংলাদেশে এই সিধ্বান্তের আলোকে কাজ করার জন্য দেন-দরবার চললেও মহামান্য প্রাধানমন্ত্রীর নেক নজরে কেউ এখনো আনয়ন না করায় তা ফাইলে চাপা পরার মতো চেপে গেছে।
প্রশ্ন জাগে সাধারণ মানুষ এবং বাংলাদেশের নিন্মবুদ্ধি বা কুয়ার ব্যাঙ শ্রেণীর আলেমগণ কেন অধিকতর রেশনাল, ফ্যাক্ট বেইজড সিদ্ধ্বান্তের দিকে যাচ্ছেন না?
সরকার, বিজ্ঞানে অবিশ্বাস এবং অহেতুক ভয়ের রোমাঞ্চ থেকে পরিত্রান না পাবার পণ একটি বিরাট সংখ্যাক মুসলিমদের কে পিছনে ফেলে রাখছে। মুসলিম শাসক আল মামুনের রাজত্বকালে আকাশতত্ত্ব নিয়ে গবেষণা শুরু হয়। প্রখ্যাত বিজ্ঞানী আবুল হাসান নবম শতাব্দীতে দূরবীক্ষণ যন্ত্র আবিষ্কার করে জ্যোতির্বিজ্ঞানের পথ উন্মুক্ত করেন। দশম শতাব্দীতে বিজ্ঞানী আল বাত্তানি সৌরমন্ডলের গতি চান্দ্রমাসের সঠিক গণনা, চন্দ্রগ্রহণ ও সূর্যগ্রহণের তথ্যাদি নির্ণয় করে বিশ্বব্যাপী খ্যাতি অর্জন করেন। কিন্তু এরপরের আলেম সমাজ তাবিজ-কবজ আর তালাক এবং ইহুদি-খ্রিষ্টান আতঙ্কে নিজেদের নিমজ্জিত করায় আজ তারা চাঁদ দেখা-না দেখার মতো সাধারণ প্রশ্নে লড়াই এবং ইগ্নোরেন্সকে বেছে নিয়েছেন।
৪ জুন (মঙ্গলবার) সন্ধ্যার পর কলকাতার মসজিদ-ই-নাখোদা মারকাজি রুয়াত-ই-হিলাল কমিটি এক বিবৃতিতে এ তথ্য জানিয়েছে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় শাওয়াল মাসের চাঁদ দেখা গেছে। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার এবং তথাকথিত প্রখ্যাত আলেম সমাজ, খানকা-পীরবাবাগণকে দুই দুইবার প্রেস ব্রিফিং করে নতুন চাদের আগমন নিশ্চিত করতে হয়েছে। এমন ঘটনা বাংলাদেশে প্রথম নয়, কাছের ইতিহাসে খুব সম্ভবত ১৯৯৭/১৯৯৮ সালেও একবার মানুষ তারাবীর নামাজ পড়ে ঈদের চাদের খবর লাভ করেছে! হয়তো এখানে কোন রাজনীতি নেই তবে মুর্খতা এবং ইগো নিশ্চিত রয়েছে। ইসলামকে ডোবার আবদ্ধ পানির মতো করে চিন্তা করা, ইসলামে রিফরমেশন আনতে না দেয়া বা রিফরমেশনের চিন্তা না করা এমনতর সমস্যা জিইয়ে রাখছে।
সময় হয়েছে ইসলাম নিজেকেই নিজে চ্যলেঞ্জ করার। আপনাকে ছাড়া তা কি সম্ভব?