Tuesday 13 December 2011

আমার আমি - ০৭

ভরা এক বর্ষার ঢলে আমি মুক্তি পেয়ে ভেষে আসি, সাথে নিয়ে অভিযোগের পাহাড়। আমার বাবা ঠিক নিতে পারছিলেন না, সমাজে সম্মানিত, ওরাছাতুল আম্বিয়াদের অবিস্বাস করবেন না আমাকে বিশ্বাস করবেন... আমার তাতে কিছু যায় আসে না, আমি মুক্তি পাচ্ছি, এটিই আমার কাচ্ছে স্বপ্ন মনে হচ্ছিল। আমাদের সাথে বাবার এক বন্ধুও ছিলেন। ক্ষোভে কাতর আমার বাবা আমায় বকছিলেন, পড়াবেন না, আজে লাগিয়ে দেবেন, আমি বেয়ারা, বলে নিজের রাগ ঝারছিলেন। আবার এখন কি করতে চাই তা ওনার বন্ধুর মাধ্যমে জানতে চাইছিলেন। অবশেষে বাবার সেই বন্ধুর পরামর্শে ঠিক হলো আমায় এবারও মাদ্রাসায় ভর্তি করা হবে, আমায় জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো কোথায় পড়তে চাই, আমি সাহস করে বলতে পারিনি, আমি আর মাদ্রাসায় যেতে চাইনা। আমায় মুক্তি দাও ! না, আমার মনের কথা শূনেনি সর্বজ্ঞাতা,পরম শ্রোতা কিংবা আমার বাবা...সেই সময় ভাবতাম এই আমার নিয়তি। এবার আমি আরেক নতুন জগতে, নতুন ধারায়, আমি ভর্তি হবো আলিয়া মাদ্রাসায়।
সিলেট শহরে সরকারী আলিয়া মাদ্রাসা থাকলেও আমায় ভর্তি করা হলো শহরের বাইরে অজপাড়া এক গায়ের মাদ্রাসায়। এর বিশেষত্ব এখানে ছাত্র রাজনীতি নেই বিশেষত শিবির নামের আতঙ্ক সেখানে নেই, এক পীর সাহেব এর প্রতিষ্ঠাতা, পড়াশুনার মান ভালো।
বাস চড়ে,টেম্পু করে, চলে এলাম এক নদীর ঘাটে। আমি গাছ বাইতে জানিনা, সাইকেল চালাতে জানিনা আর জানিনা কিভাবে সাতার কাটতে হয়। ডুবে মরার ভঁয় নিয়েই মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল সাহেবের অফিসে এসে পৌঁছলাম। প্রিন্সিপাল সাহেব আমায় দাড়ি কাটতে পারবোনা ( আমার দাড়ি তখনো উঠেনি ), চুল ছেটে রাখতে হবে ( কওমি মাদ্রাসায় ন্যাড়া করে রাখতে হতো ), তাবলীগে নিয়মিত যেতে হবে জানালেন। অতপর একজন শিক্ষক আমার যোগ্যতা যাচাই করে ক্লাস সেভেনে ভর্তি করালেন। বছর শেষ হতে মাস তিনেক বাকি, আমায় প্রমান করতে হবে অনেক কিছু। আমার থাকার ব্যাপারে ঠিক হলো আমি লজিং থাকবো মাদ্রাসার কাছেই এক বাড়ীতে। সেদিন সন্ধ্যায় আমি এলাম আমার নতুন ঠিকানাতে। সেখানে আমি এক ক্ষুদিরাম আমার আবার তিন মেয়ে শিষ্য। পড়ার টেবিলে আমরা চারজন। আমাদের পরিচয় পর্ব শেষ হলে, ওরা আমায় জানালো আমার ক্লাসের এক মেয়ে থাকে ( সেই মাদ্রাসাতে কো এডুকেশন ছিলো )।
ক্লাস রুটিন আনতে পাঠালে সেই সহ পাঠিনি রুটিনের নিচে লাভ সিম্বল একে তাতে এ + আর লিখে পাঠান। আমি তাকে আমার সময়ে কখনো সরাসরি দেখিনি।
রাত পোহালে হলো শুরু এক নতুন দিনের, নতুন যাত্রার।

Sunday 11 December 2011

আমার আমি - ০৬

প্রিয় পাঠক, আপনি কি কখনো পানির নিচে, বায়ুহীন ঘরে কিংবা দুঃস্বপ্নের ঝড়ে অথবা অদ্ভুত কোন দর্শকদের ভীরে পড়েছেন ? যদি না পড়ে থাকেন তবে আসুন আমার সাথে, ঘুরে আসি এমনি কিছু সময়ে,যেখানে বসত করছেন কিংবা করেছেন এমন কিছু মানুষ !
ঐ জীবনে আমাদের ছিলো না উরে যাবার কোন আকাশ, ছুটে চলার জমিন, দৃষ্টি খুলে দেবার আলো। সেই অন্ধকারেও মাঝে মাঝে আমরা আনন্দিত হতাম । প্রতি বৎসর হেফজ ও দাওরায়ে হাদীস সমাপ্ত করা উপলক্ষ্যে সম্মাননা প্রদান ও ওয়াজ-মাহফিলের আয়োজন করা হতো। এই অনুষ্ঠানে ভারত,পাকিস্তান,আফগানিস্তান,লন্ডন থেকে বিশেষ বক্তাগণ আসতেন। চারিদিকে উৎসব ভাব বিরাজ করে, আমরা এই আয়োজন ও এতো মানুষের সমাগম দেখে অভিভুত হই। সেবার ভোরে, খুব ভোরে আমাদের ডেকে তোলা হলো। নির্দেশ হলো সবাইকে মাদ্রাসা মাঠে জমায়েত হতে, এরপর যা আমি গত এক দেড় বছরে দেখিনি তাই হলো। আমাদের লাইন করে দাড় করিয়ে দেয়া হলো , শুরু হলো লেফট-রাইট, সামরিক কায়দায় কুচকাওয়াজ। আমরা ঘন্টা খানেক ট্রেনিং নিয়ে সিলেট স্টেশনের দিকে চললাম। যেতে যেতে জানলাম একজন সম্মানিত অতিথি আসবেন, তিনি মোজাহিদ তাই তাকে সামরিক কায়দায় স্বাগত জানিয়ে নিয়ে আসা হবে। স্টেশনের নিয়ম ভেঙ্গে আমরা সবাই হুরমুর করে প্লাটফর্মে ডুকে গেলাম।
মাহফিলে আসা শ্রোতাদের কে বিভিন্ন ডিস্প্লে দেখানো হতো, যেমন দাফন-কাফন প্রক্রিয়া,ঈদের নামাজ, ইলেক্ট্রিক্যাল ওয়ার্ক এবং আরবী ও ইংরেজীতে কথোপকথন। সেবার আমি ও জামিল ছিলাম ইংরেজী কনভারসেশন প্লে 'তে। মানুষ কখনই জানবেনা যে আমরা একটি স্ক্রিপ্ট মুখস্ত করে শুধুই অভিনয় করছিলাম। খোদার ঘরের সামনে,নবীর বাগানে বসে এতো মানুষকে ধোকা দিতে তাদের না বাধলেও আজ আমার লজ্জা লাগে, অপরাধ বোধ হয়। ধর্মের কলকব্জা নাড়াচাড়া করা এই লোকগুলিকে সন্দেহ করার যথেস্ট কারন সৃষ্টি হয়।
প্রিন্সিপাল মাওলানা হাবিবুর রাহমান প্রতি বছরই ধর্ম বিষয়ক একদুইটা চটি বই বের করতেন। তেমনি একটি বই ছিলো '' আফগান রণাঙ্গনে আমি আল্লাহকে দেখেছি '' ।
দেখতে দেখতে বছর ফুরিয়ে গেলে আমার বাবা তার এক বন্ধুর প্রভাবে আরো ভালো মাদ্রাসার খোজে আমায় ভর্তি করলেন বিয়ানীবাজার অঞ্চলের আঙ্গুরা মোহাম্মদপুর মাদ্রাসায়। প্রত্যন্ত অঞ্চল, বন্যা,চরম লোড শেডিং, রুচিহীন খাওয়া দাওয়া। কাজির বাজার মাদ্রাসার হোস্টেলের মতোই হোস্টেল। বাড়তি শুধু খাঁটি গ্রাম। আমি ভর্তি হলাম ছাফেলা দুওমে, আবারো একই ক্লাসে দ্বিতীয়বার পড়ছি।
আমাদের একটি সাবজেক্ট ছিলো ''মালাবুদ্দা মিনহু'' , ফারসী ভাষায় ইসলামী আইন বিষয়ক বই। আমি এর ক্লাস ওয়ার্ক ও পরীক্ষা বাংলাতে দেয়ায় যে হয়রানি ও ঠাট্রার শিকার হয়েছি তাতে মনে হয়েছিলো লজ্জা বোধ হয় বাংলাতেই। সেই ঘটনার সুত্র ধরে জ্বলঢুপের হুজুর নামে এক হুজুর আমায় ক্লাসে জানতে চান আমি কোন দল করি,আমি জবাবে না জানালে তিনি আমায় বেত্রাঘাত করতে করতে ,আমায় বলতে বলেন জমিয়ত করি। বস্তুত তাদের ধারনা হয়েছিলো আমি কাজির বাজার মাদ্রাসা থেকে এসেছি,সুতরাং আমি মজলিস করি। ক্লাসে এই নির্যাতনের পর তিনি আমায় তার রুমে নিয়ে গিয়ে ইলেক্ট্রিক্যাল ওয়্যার দিয়ে পেটান ! এরপর দিন চলতে থাকে...
আমি আবিষ্কার করি আমাদের ব্লকের সুপার মাওলানা ফখরুল ইসলাম আমাদের পাশের রুমে থাকতেন। প্রায়শই তার রুম থেকে তার সেবায়েত আলী আকবর ও তার ফিসফাস কথা বার্তা ও হাসাহাসির শব্দ পেতাম !
ক্লাসের শেষে বিকেলে আমি মাদ্রাসার নতুন ক্যাম্পাসে বেড়াতে যেতাম। একদিন দেখি সেখানে কিছু সিনিয়র ভাই ও আমার সাথের দুজন ছেলে হাতে বাশের শুকনো লম্বা টুকরা নিয়ে সোর্ড ফাইট করছে। দুজন তাদের কে বিভিন্ন ভাবে দেখাচ্ছে। এরপর থেকে আমিও নিয়মিত যেতে থাকলাম। প্রতিরক্ষা, আক্রমণ, হাইকিং,লাফ দেয়া শিখলাম।কিছুদিন পর কেন জানি আমি আর যাইনি।
একদিন সন্ধ্যায় আমাদের সবাইকে নিচে ডেকে পাঠানো হলো, বাইরে থেকে কে একজন এসেছেন,তিনি আমাদের উদ্দ্যেশে ভাষণ দেবেন এরপর গ্রুপ ট্রেনিং হবে।
ইতিমধ্যে বর্ষা চলে এসেছে,চারদিকে পানি আর পানি...আমি বাসায় ফিরে আমায় রাজনৈতিক ইস্যু নিয়ে পেটানোর ঘটনা জানালে,আমার মা বাবাকে বাধ্য করেন আমায় ফিরিয়ে আনতে। কিন্তু অবাক ব্যাপার ধর্মের এই পণ্ডিতেরা আমার নামে কাল্পনিক অভিযোগ তুলে সব অস্বীকার করেন ! আমি শুধুই অবাক হই...

Saturday 10 December 2011

আমার আমি - ০৫

তার নাম মোতালেব। বাড়ি কোথায় মনে করতে পারছিনা। তার যে কথাটি আজো কানে বাঝে '' আরে হুচ্চুত কইচ্চে ''।
এটা গুরুত্বপুর্ণ নয় যে মোতালেবরা কোথা থেকে এসেছে, আমার আপনার চারপাশে mr / miss মোতালেবরা রয়ে যাচ্ছে, সয়ে যাচ্ছে অভিশপ্ত জীবন।
আমরা যারা পরিশোধ করে খেতাম, তারা ব্যাতিত বাকি সবাই ( শিশু ও কিশোর গণ সহ )দু বেলা ( সকাল ৯ এবং বিকাল ৫ ) খেতে পেতো। ক্ষুধার তাড়নায় কিছু ছাত্র শিক্ষকদের খাবার ডাইনিং থেকে তোলার কাজ করতো। সেই সাথে তারা সেই শিক্ষকের কাপড় কাচা, ফুট ফরমায়েশ খাটা, শরীর ম্যাসাজ করা ছিলো তাদের কাজের অংশ। বিনিময়ে তারা সেই শিক্ষকের খাবার অবশিষ্টাংশ পেতো। এ ছাড়াও কিছু ছাত্র পুণ্য ভেবে এসব সেবা ( ! ) দিয়ে থাকতো। আমার সাবজেক্ট মোতালেব তাদেরই একজন।
একদিন আছরের নামাজের পর আমরা মসজিদের সামনে উদ্দেশ্যহীন ভাবে ঘুরছিলাম, কেউবা নির্মাণ সামগ্রী হিসাবে আনা পাথরের উপর চড়ছিল। আমাদের সাথে মোতালেবও ছিলো, হঠাত তাকে মাওলানা লুতফুর রহমান ডেকে নিলেন। মোতালেব ছিলো তার সেবায়েত। আমরা যে যার মতো ছিলাম কিন্তু হঠাত করে জকিগঞ্জের কালিম আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে নেয়। আমাদের রুমে ফিরে এলে দেখি ইতিমধ্যে মোতালেবকে ঘিরে কয়েক জন কথা বলছে, এদের কেউ আবার মোতালেব কে ধমকাচ্ছে। আমাদের কয়েক জন কে রুম থেকে বের করে দিয়ে তারা নিজেদের মাঝে কথা বলছিলো, আমরা রুমের বাইরে থেকে মোতালেবকে ধমকানোর শব্দ শুনছিলাম। এরপর আর কারো কাছে বিষয়টি অজানা ছিলোনা। মোতালেবকে দুষ্ট ছেলেরা '' হুচ্চুত '' বলে ক্ষেপাত। প্রকাশ্যে কেউ কেউ তাকে গাল,বুক টিপে দিতো। এ রকম প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য আরো কয়েকজন সখি টাইপ ছেলে ও যুবা ছিলো, তন্মধ্যে শায়খুল হাদীস ইসহাক সাহেবের ছেলে ( নাম সম্ভবত ইয়াহিয়া ), লাইব্রেরীতে বসবাসকারী মুফতি শফিক, মাওলানা মমশাদ, মাওলানা রিয়াজ, মাওলানা যাইনুল সহ আরো কিছু ছাত্র ছিলো যাদের পেছনে বাকি ছাত্ররা হাসতো !
এধরনের আলোচনা সব সময় নীরবে আর পেছনেই হতো। সবখানেই ছিলো ভয়ের বসবাস।
পড়েছি দেশ বিভাগের কিছু আগে কলকাতার মুসলমানগণ শ্লোগাণ দিতেন,
কানপে বিড়ি, মু মে পান...লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান আর আমার মাদ্রাসার সহপাঠিরা ভাবতো মাদ্রাসা বেহেস্তের গুলিস্তান, তাদের মুখে থাকতো পান, বাংলাকে করবে আফগান ! নবীর বাগানে এ কোন লীলা খেলা ? হাজার হাজার ফেরেশতারা তখন কোথায় থাকেন আর কি করেন ?
এই ঘটনার প্রায় দশ বছর পর আমি হঠাত করে মোতালেব কে নিয়ে ভাবতে শুরু করি, আমি কোথাও ছেলে/পুরুষ ধর্ষনের কোন শাস্তি,আইন এমনকি কোন পরিসংখ্যান খুজে পাইনি। যদি কোন ছেলে/মেয়ে তার শৈশবে কোন ভাবে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয় তবে এর প্রভাব তার জীবনে কি হতে পারে ? সে কি পারবে আর কাউকে শারীরিক ভাবে ভালবাসতে ? ভালবাসার রঙিন সেই মুহুর্তে কি বিভিষিকাময় সেই স্মৃতির ভয়ংকর সে মুখটি কি বারবার ভেসে আসবে না ? ধর্মকারীগণ তাদের সবখানে বিরাজ করা খোদা কে কেন সেই সময়ে কেন তার প্রেম ও শক্তি নিয়ে সামনে আসতে দেখে না ? এটা তার কোন খেয়ালি পরীক্ষা ? খবরের কাগজে পড়েছিলাম ভারতে বিভিন্ন পেশাজিবি পুরুষ নির্যাতন রোধ আইন প্রবর্তন করতে রেলী করছেন। সময় এসেছে মানুষ রুপি এই দানবদের বিচারের মুখোমুখি করার। ধর্মের হাসিস পান করা ধার্মিকদের মুখোশ খুলে দেয়ার। সেই যুগে ব্রাক্ষণ, পুরোহিত এরপর মাদ্রাসা, মসজিদ এরপর চার্চ ধর্মের আবরনে নস্টাচারের এই খেলা দুর্বল মানুষের খেলা খেলে চলেছে আদি কাল থেকে...কখনো মেয়েদের সাথে কখনো ছেলেদের সাথে, তাই এখনি সময় ঘুরে দাড়ানোর।

Tuesday 6 December 2011

আমার আমি - ০৪

জননেত্রী শেখ হাসিনা তখন আওয়ামী লীগের প্রধান মন্ত্রী,মাথায় পট্রি,হাতে তসবি আর মুখে জাতির পিতার হত্যা শোধ ভুলে যাবার যপ নিয়ে দেশের নতুন ত্রাতা তিনি। দীর্ঘ ২১ বছর পর সরকার গঠণ করে আওয়ামী লীগ। কিছুদিন না যেতেই দেশ থেকে ইসলাম বিনাশের অভিযোগে হাহাকার করে উঠে ধর্মপ্রাণ মুসলিম জনতা, ঠিক একই সময় দেশ ভারতের কাছে বিক্রি করে দেয়ার অযুহাতে হাত গুটাচ্ছে বি এন পি। এই মহা যজ্ঞের প্লাটফর্ম সিলেট অঞ্চলে গড়ে তুলতে ইমানী দায়িত্ব পালন করছেন মাওলানা হাবিবুর রহমান, মাওলানা মজুদুদ্দিন ( মুহতামিম/ প্রিন্সিপাল, ভার্থখলা মাদ্রাসা), মাওলানা আলি আকবর ( ইমাম ও মুহতামিম, দরগা মাদ্রাসা), শায়খে কাতিয়া, রেঙ্গা, ও গহরপুরি পীর সাহেবগণ ( স্বাধীনতা বিরোধী রাজাকার নেতৃত্ব বৃন্দ ) এবং তাদের সাথে তাদের অনুসারী ও তাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রগণ। সেই উত্তাল সময়ে আমি তখন ছাফেলা দুওমে পড়ি। প্রায় প্রতি সপ্তাহে মিছিল থাকতো। উপরের ক্লাসের বড় ভাইরা মিছিলের দিন ক্লাসে ক্লাসে এসে সবাইকে মিছিলে অংশ গ্রহণের জন্য নির্দেশ দিয়ে যেতেন। উপরন্তু বের হবার সম্ভাব্য সব পথে পাহারা দিতেন। আমি অতি উৎ সাহ নিয়ে সেই সব মিছিলে যেতাম। ছন্দে ছন্দে বিভিন্ন শ্লোগান দিতাম যা সেই সময় আমায় আমোদ দিতো। কিছু শ্লোগান বলার লোভ সামলাতে পারছিনা...
নারায়ে তাকবির, আল্লাহ হু আকবর।
আমরা সবাই তালেবান, বাংলা হবে আফগান।
রুশ ভারত মার্কিন ফুরিয়ে গেছে তোদের দিন।
মরলে শহীদ বাঁচলে গাজি, আমরা সবাই মরতে রাজি।
মাওলানা সাইদী বাংলার ইহুদি।
একটা দুইটা মুর্তাদ ধরো , সকাল বিকাল নাস্তা করো।
জেলের তালা ভাঙবো , ...কে আনবো।
জাহানারা ইমাম ( শহীদ জননী ), জাহান্নামের ইমাম। ইত্যাদি...
রাজনৈতিক এই সকল কর্মকান্ডে আমার মতো শিশুদের অংশ গ্রহণ সামান্য ছিলোনা কিংবা কালে ভদ্রে হঠাৎ ছিলোনা ! এই সবের পেছনে ছিলো সাহাবা পরিষদ বাংলাদেশ, খেলাফত মজলিস, ইসলামী ঐক্যজোট বাংলাদেশ, নাস্তিক মুর্তাদ বিরোধী আন্দোলন নামক সংগঠন। অবাক ব্যাপার হলো এই সব গুলো সংগঠনের প্রথম সারির নেতা ছিলেন প্রিন্সিপাল হাবিবুর রহমান। পৃথিবীর কোন সভ্য দেশের্‌, সভ্য নাগরিক কোন শিশুকে কিংবা কোন ছাত্রকে, নিজ রাজনৈতিক লক্ষ্য বা লিপ্সার জন্য ব্যাবহার করবেনা। এই সেই মাওলানা যিনি ব্রিটেন থেকে মদ বিক্রির টাকা অনুদান হিসেবে আনতেন আর শুক্রুবার তার মসজিদে মদ বিক্রি,মদ পান কে হারাম বলে বলে হয়রান হতেন। খালেদা কে লেদা ( গো মল ), হাসিনা কে চেনা (গো মুত্র ) সম্বোধন করে, নারী নেতৃত্ব হারাম, দেশে নারী নেতৃত্ব আসলে দেশ তসবীর দানার মতো ধংষ হয়ে যাবে প্রচার করে মসজিদে ওয়াজ করতেন। তার ওয়াজ করার , মানুষকে মোহিত করার ক্ষমতা ছিলো অসাধারণ। প্রতি সপ্তাহে মানুষের ঢল নামতো। সেই একই ব্যাক্তি মাত্র এক দশক পর একবার খালেদা-সাঈদীর সাথে এবং এর পাঁচ বছর পর আওয়ামীলীগের হয়ে নমিনেশন নিয়ে নির্বাচন করতে নামেন।
আমাদের শৈশব কে নষ্ট করে, আমাদের মতো হাজারো বাংলাদেশের বভিষ্যত কে দিকভ্রান্ত করে, নিজের দেশের কাছে পরদেশী করে দিয়ে তারা আমাদের জাতীয় পতাকা নিয়ে ঘুরে বেড়ান !
যে মিছিলে মিছিলে মানুষ তার অধিকার, তার মতামত প্রকাশের জন্য মুষ্টি কে শূন্যে ছুড়ে দেয়,দীপ্ত তেজে শ্লোগান বলে তা ছিলো আমার বাহির হবার বাহানা ! আমার জন্য যা ছিলো শুধুই না জানা অংশ গ্রহণ তা আর সব মানুষের জন্য ছিলো আতঙ্ক। আপনারা যারা শৈশব কে চোখ বন্ধ করে দেখেই বারবার ফিরে যেতে চান, আমি সেই শৈশবে আর ফিরে যেতে চাইনা ! এমন নিরস, প্রতিবন্ধকতাময় সময়ে কোন সুস্থ মানুষ ফিরে যেতে পারেনা। আমার মতো হাজার হাজার ছেলে তার দুরন্ত শৈশব কৈশর কখন যে হারায় তা তারা নিজেও জানেনা। আমি ঘুড়ী উড়িয়ে দেখিনি,কাদাময় মাঠে বলের পেছনে ছুটিনি, তপ্ত রোদে রান করার জন্য মাঠে নামিনি, কার্টুন দেখার জন্য দাড়াতে পারিনি, আমের গাছে চড়ে বেড়াইনি...আমার সাথে ট্যাগ লাগানো ছিলো আমি খোদার খাশির মতো উৎসর্গক্রিত। আমায় এসবে আসতে মানা !
প্রতি শুক্রুবারে বিটিভি তে আলিফ লায়লা প্রচার করা হতো। বাসায় থাকতে এক-দুই বার দেখার সুযোগ পেয়েছি কিন্তু এই বন্দিখানায় তা অকল্পনীয়। আমাদের মাদ্রাসার পাশেই ছিলো নর্থ ইষ্ট মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল । সেখানের রিসিপশনে টি ভি রাখা ছিলো, একবার এশার নামাজ ফাঁকি দিয়ে আলিফ লায়লা দেখতে সেখানে গেলে, ধরা পরে যে শারীরিক নির্যাতনের শিকার আমরা হয়ে ছিলাম তা মনে হলে আজও আমি শিউরে উঠি ! হোস্টেল সুপার মাওঃ আব্দুস সোবহান সাহেব ও মাওঃ আব্দুল খালেক সাহেব, মাওঃ বাহুবলী হুজুর গণ আমাদের র‍্যাবের মতো পেটানোতে বিশেষ পারদর্শি ছিলেন। তারা এ ধরনের অপরাধের বিচার করতেন। আমি ভেবে পাইনি আলিফ লায়লা তে কি ছিলো যা আমায় খারাপ ছেলে হবার কারন হতে পারে। ঐ সিরিয়ালটির বেশির ভাগ ছিলো মুসলমানদের নিয়ে গল্প ভিত্তিক। আমি কি জানতে চাইতে পারি মৌলোভী সাহেবরা এসব না দেখে কিভাবে জানলেন এসবের সব কিছু খারাপ ? কোন জিনিসই যে অতিরিক্ত ভালো নয় তার প্রমান কিছু ছেলে পাশের সিনেমা হলে সিনেমা দেখতে যেতো ! পড়নের পাঞ্জাবীকে ভাজ করে পাজামার ভেতর দিয়ে কিংবা টি শার্ট চাপিয়ে সিনেমা দেখতে যেতো। দিলশাদ সিনেমা হলে ২x গল্পের সিনেমা প্রদর্শন করা হতো, কিছু ছেলে গোপনে তা দেখতে যেতো। সন্ধ্যায় লোড শেডিং এর সময় কিছু ছেলে অত্যন্ত নোংরা গল্প করতো। মানুষের জীবনে বিনোদনের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। স্বাভাবিক বিনোদনের অভাব থেকেই মাদ্রাসা গুলোতে সবচেয়ে বেশি সমকাম কিংবা শিশু যৌন নির্যাতনের ঘটনা বেশি ঘটে থাকে !
সেই সময়ে একটি ঘটনা আমায় বহুপরে এতো বেশি ভাবিয়েছে যে তার প্রতিকারের ভাবনা আজ আমায় এই লিখায় অন্যান্য সমস্যার সাথে সব কিছুকে আর সবার সামনে আনতে উতসাহ যুগিয়েছে